home about join contact

Friday, December 10, 2010

কেন আঁকিব??

কেন আঁকিব??

"কবিতা অপরিহার্য- কিন্তু ক্যানো তা যদি জানতাম"
                                            -- ফরাসী কবি জাঁ কঁকতো
আমরা আঁকি
লোকের ভাষায় শুধু আঁকি-ই, কোনো কাম করি না।
অর্থাৎ এই কামের কোনো বাজার দর নাই, এরে ধরা যায় না, মাপা যায় না, ভালো হইসে না খারাপ হইসে তা বলা যায় না। এরে বোঝা তাই নিত্য গেরস্থের কাছে সময়ের অপচয় বোধ হয়। এরে তাই ঠেইলা দূরে রাখাই ভালো। কিন্তু ক্যান জানি এরে বাদ দিয়াও চলা যাইতেসে না। বাজারের থলি আর বিছানার চাদর ফুঁইড়া কেম্নে জানি এই জিনিস চইলা আসে। তাই আমরা নীরবে মাইনা নেই যে আঁকিউঁকি ব্যপারটা অপরিহার্য,
কিন্তু ক্যান- তা জানি না...
আমরা কতিপয় 'আকাইমা' আঁকিয়ে তাই মাঝে মাঝে ন্যাতান্যাতা ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আর লেবু চা সহযোগে আমাদের আকামের পক্ষে একটা যুক্তি দাঁড়া করাবার চেষ্টা করি। আমরা আঁকাউঁকির দিকে তর্জনী উঁচানো প্রশ্নগুলিরে তাই কোনোমতে ঠ্যাক দিতে ব্যপারটারে এনালিটিকালি ভাগ কইরা ফালাই, যেমন:
                           
                           ১. বাজার দর
                           ২. ধরা ও ছোঁয়া
                           ৩. বোঝা 

১. বাজার দর
বলা হয়, আর্ট যে বাজারে বিক্রি করা যায় সেইটা আমাদের শিখায়া গেছে বিটিশ একটা কোম্পানি। আমরা ভালোই ছিলাম মাটির পুতুল, পাহাড়ের গাও, ঘরের কাঁথা-বালিশ, পাখা, মাদুর, পাটি আর পালাপার্বণের পট নিয়া, আমরা সিম্পলি ভাল্লাগতো তাই আঁকতাম। তার আগে বারোশো শতকে দুই হাত লম্বা এক লোক তার হাতের চেয়েও আরো লম্বা এক ফর্দ নিয়া আসসিলো যার লেজে বাইজা একসময় দাঁড়াইলো- আঁকা অতি জঘন্য কাজ। (আমরা সেই প্রসঙ্গে আরেকদিন আসি?) একটা বিরাট কম্যুনিটি চোখ বুঁইজা তখন খালি মোটিফ বেইজড কাজ কইরা গেছে, প্রাণহীন মোটিফ। আর অন্যদিকে ধলাপাহাড় বিটিশরাজ? তারা আইসা যা বাকি আছিলো সেইগুলা দেইখা ছিছিক্কার দিতে লাগলো। বলল - এইগুলা আবার আর্ট নাকি? নাক নাই, গলা নাই, এইগুলা সব ট্র্যাশ, এইগুলা EXOTIC! এইগুলা ORIENTAL! ফালাও ফালাও সব ফালাও। নতুন কইরা শিখো- এই দিলাম গোল্লা, এই দিলাম লাইন, এই হইলো লাইট এন্ড শেড, আর তোমাদের কালার এতো ক্ষ্যাত ক্যান? যত্তসব চাষাভুষা, রঙ হইবো এম্বিয়েন্ট, টার্শিয়ারি হুইলের খেলা। যাও যাও স্কেচ খাতা বানাও আগে, পাহাড়ের গা কি আবার একটা আঁকার জায়গা হইলো? আমরা ছুটলাম স্কেচ খাতা কিনতে। আমাদের ছবির সাইজ হইতে লাগলো ড্রয়িং রুমের দেয়ালের মাপের। অজন্তা আর এলোরার কর্মকারদের বংশধর বসে গেলো জমিদার আর লালমুখা সাহেবদের পোর্ট্রেইট আঁকতে। অর্থাৎ কিনা আর্ট আসমান হইতে মাটিতে নামলো , সেইখান থিকা ক্রল কইরা ঢুকলো বড়লোকের ড্রয়িংরুমে। কিন্তু কথা হইলো আসমানে থাকলে কি আঁকিয়েদের না খায়া মরতে হইতো না? বিটিশরা কি ভালো করে নাই?
কথা আসলে সেইখানে না, কথা আরেক জায়গায়। কথা হইলো আমাদের আঁকিবুঁকি অচিরেই তার নিজের বাজার খুঁইজা নিত মাঝখান থিকা বিটিশ আইসা এতদিনের পুরা হিস্ট্রিরে বলল 'ফালতু!' অর্থাৎ এতদিনের বাইড়া ওঠা মহীরূহ এক পোঁচে কাইটা একটা প্লাস্টিকের ফুল গাছ লাগায়া দেয়া হইলো। মহীরূহের অপরাধ- তার ফুল নাই। সেই প্লাস্টিকের গাছটারে আমরা এখোনো পানি ঢাইলা যাইতেসি।
ভালো কথা- আমরা তো এদ্দিনে  পানি ঢাইলা ঢাইলা সেই প্লাস্টিকের গাছটারে না পারসি পচাইতে না পারসি বড় করতে ওইদিকে বাজারের কী অবস্থা? বাজারের অবস্থা আসলে ভালো। কারণ বিলাতি- পশ্চিমা অশিক্ষিত সমাজ হঠাৎ GOOGLE বইলা একটা জিনিসের সন্ধান পাইসে, যার মাধ্যমে তারা জানতে পারছে  যে, "We are not alone" তারা এখন জানে পৃথিবী গোল। আর পুরাটা আসলে কানেক্টেড। তারা দেখতে পাইলো গাছের পাতা খালি লাল আর হলুদ না সবুজও হয়। তো তারা যেহেতু ওই বিটিশদেরই ঘুইরা ফিইরা ভাই বেরাদর, তারা মূহূর্তের মধ্যে এইটার বাজার দর বাইর কইরা ফেলল। তারা বুঝলো যে এইটা হইলো 'No one has ever seen before'। এইটারে সেল করা যায়। অর্থাৎ হিস্ট্রি রিপিট হইতে লাগলো, আমাদের তুলা নিয়া ইংল্যান্ডের সুতাকল কাপড় বানায়া যেমন আমাদেরই কাছে আবার বিক্রি করত- সেই হিস্ট্রি। তারা এখন যেইটারে একদিন EXOTIC বইলা ফালায় দিতে বলছিলো তারা এখন সেইখানেই নজর ফিরানো শুরু করছে। তারা টের পাইছে যে তাদের জাতিগত ইতিহাস নাই। আছে পাতিহাস। তাদের কোনো নৃতাত্ত্বিক ইতিহাসওয়ালা পুতুল নাই আছে বার্বিডল। তাদের কোনো আর্ট ভ্যালুওয়ালা পেইন্টিং নাই ( এক whistler-এর মাকে দিয়া আর কদ্দিন?), আছে মনোটোনাস বাণিজ্যিক আর্ট যদিও মাঝে POP art  টপ আর্ট দিয়া একটা ব্যালান্স আনার চেষ্টা করা হইসিলো। কিন্তু তারা অবাক হয়া খেয়াল করলো আমাদের আর্ট হিস্ট্রি তাদের টোটাল হিস্ট্রির ১০ গুণ বড়! 

এদিকে আমরা আবার হাল আমলে 'খোলা বাজার' 'এক দুনিয়া' 'বিশ্ব-গ্রাম' ইত্যাদি দুর্বোধ্য কথার ধোঁয়াশায় ধরা খাওয়া শুরু করসি। মুক্ত বাজার যে আসলে পুরাপুরি ‘মুক্ত’ না, ব্যপারটা যে আসলে “সবাই সমান আর কেউ কেউ একটু বেশি সমান”— এই নীতিতে চলে তা আমরা প্রায় ধইরা ফেলসি। অর্থাৎ ‘বাজার’ জিনিসটা এখনো আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকলো। এখন একবাক্যে আমরা এইটা সকলেই জানি যে বাজার বইলা আসলেই যদি কিছু থাকে সেইটা আমাদেরই ধরতে হবে। কেউ আইসা ধরায়া দিবে না। এই মুহূর্তে সেইটা না বুঝতে পারলে আখেরে আমাদের নিজেদের কাঁচামাল বাইরের থিকা প্যাকেট হইয়া আসবে আর আমরা লাইন ধইরা সেইটা গাঁটের টাকা খরচ কইরা বগলদাবায় বাড়ি আইসা আহা উহু করব। ঘরের আলুভর্তা যেইরকম KFC তে গিয়া MASHED  POTATO নামে খায়া থাকি সেইরকম। সো, আমাদের কাঁচামাল আগে নিজেদের স্টোর করতে হবে। অর্থাৎ আঁকতে গেলে যেই সব উপকরণ, ফর্ম, আলো-ছায়া, রঙ, ঢং, টেক্সচার, মোটিফ ইত্যাদি ইত্যাদি লাগে সেগুলা নিজেদেরটা নিজেরাই যোগাড় করা। তাইলে অন্তত নিজের ঘরের জিনিস চুরি হবার পর চোরের  থেকে বেশি দামে আবার কিনতে হবে। তাই সেইটা এড়াইতে হইলে এই মুহূর্তে আঁকিবুকির জন্য নিজেদের কালচার ও আশপাশ এক্সপ্লোর করাটা মাস্ট।

২. ধরা ও ছোঁয়া
আমরা খেয়াল করলে দেখতে পাব যে আম জনতা যেই বিষয়টা নিয়া কথা বলতে সবচেয়ে ভয় পায় সেইটা হইলো ‘ধর্ম’। কী কইতে কী কয়া ফেলি এই ভয়ে মানুষ এই জিনিসটারে দূরে দূরে রাখে। আর এই সুযোগে একদল দুষ্কৃতিকারী সেইটারে নিয়া ব্যবসা ফাঁদে। তারা ব্যপারটারে আরো  ধোঁয়ার মধ্যে ফালায়া মানুষের থেকে ফায়দা লোটে। প্রায় কাছাকাছি ধরনের কাজটা করা হইতেছে ‘আর্ট’ নিয়া। ‘আর্ট’রে আর্ট ক্রিটিকরা ধর্মের মতন দুর্বোধ্য এক জিনিস বানায়া সাধারণ মানুষের থেকে দূরে সরায়া ফেলতেছে। এমন একটা ধারণা দেয়া হচ্ছে যে আর্ট সবাই বোঝে না। এইটা বোঝার জন্য নন্দনতত্ত্ব, মনস্তত্ত্ব, আঁতেলতত্ত্ব– ইত্যাদি সব কিছু জানতে হবে। আর্টরে ধরা ও ছোঁয়া অসম্ভব- এমন কথাই তারা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। আম জনতা কইলো –‘ডরাইছি’ তাই দৈনন্দিন জীবনে ধর্মরে মানুষ যেমন সরায়া রাখে আর্ট রেও সে সহজে নিজের মত কইরা ভাবতে সাহস পায় না। মনে করে কী জানি ভাই আমি কম বুঝি, নিশ্চয়ই জিনিসটা ভালো হইসে, আমি গ্যঁগা(?), তাই বুঝি নাই। আমাদের ভিজুয়াল লিটারেসি তাই গুহা যুগ থেকেও পিছাইতে পিছাইতে বিগ ব্যাং-এর আমলে যাইতেসে। তাই এই লিটারেসি যদি ডেভেলপ করতে হয় তবে সবার প্রথমে আর্ট রে উপরের কুলঙ্গি থেইকা বাইর করতে হবে। ক্রিটিকদের হাত থেইকা এরে উদ্ধার কইরা আবার ধরা ও ছোঁয়ার মধ্যে আনতে হবে। 

৩. বোঝা 
‘আমি ফটোশপ পারি, আমি 3D max পারি, তার মানে আমি আসলে ভালো গ্রাফিক ডিজাইনার।’ এই মুহূর্তে সমাজে তা-ই প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু ভাইবা দেখেন আমি স্পিডে টাইপ করতে পারি, আমি প্রিন্ট করতে পারি- তার মানে কি আমি ভালো লেখক? যদি না হয় তাইলে বুঝতে হবে আমাদের বোঝায় ভুল আছে। আর্টের অবশ্যম্ভাবী দুইটা পার্ট হইলো
  • আইডিয়া
  • স্কিল
প্রথমটা হইলো দেহ, দ্বিতীয়টা ল্যাজ। দেহ ছাড়া ল্যজের মানে নাই। আর ল্যাজ ছাড়া দেহ কমপ্লিট না। বলা হয় আমাদের আর্ট ইন্সটিউট গুলিতে এ শুধু ল্যাজের চর্চা হয়। যেই মানুষটা নিজের রক্ত পানি করা ইনস্টিটিউটটা দাঁড়া করাইসিলো, যে নিজের শিল্পীজীবন উৎসর্গ করসিলো এই দেশের ভিজুয়াল লিটারেসি ডেভেলপে, দোয়া করি সেই আচার্য জয়নুল আবেদীন যেন এই কথাটা না জানেন, কোনোভাবেই না। এই একটা লোক অনেকভাবে চেষ্টা করছিলেন যাতে আমরা নিজেদের চারদিকে তাকাই, যেন আমরা নিজেদের আর্ট নিজেরা ডিফাইন করি, যেন আমরা বাজারে হারায়া না যাই। কিন্তু আমরা দিন শেষে যা করতেসি তা হইলো স্কিল বা ল্যাজের চর্চা, আইডিয়া বা বোঝার ব্যপারটায় আমরা যাইতে চাই না। আমরা নিজেদের মান নির্ধারণ করি– বাইরের মতো হইসে— এই বইলা। আমাদের বোঝার যায়গাটা প্রায় শূন্য।
সুতরাং এই বেলা ল্যাজের আগে দেহের- করবার আগে বুঝবার জায়গাটা ঠিক করতে হবে। শিল্পাচার্যের দোহাই।

কেন আঁকান্তিস?
উপরের এই তিনটা জায়গারে নতুন কইরা ধরবার টানে আসলে এই আঁকান্তিস। এইটা আসলে সাদা বাংলায় একটা আঁকিয়ে আড্ডাখানা। এইখানে আমাদের প্রধান কাজ হবে 'আঁকা'। আমরা আমাদের চাইরদিক এক্সপ্লোর (বোঝাবুঝি) করতে প্রতি সপ্তায় স্কেচখাতা নিয়া বাইর হব। আমরা ওইসব স্টাডি থেকে নতুন কী শিখলাম ও নতুন কী ভাবলাম সেইটা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করব। আমরা সেইসব নিয়া আম জনতার 'ধরাছোঁয়া'-র মধ্যে এরে নামায়া আনব। এবং ওইগুলারে নিজেদের মতো কইরা বাজারজাত করার উপায় আলোচনা করব। এবং আমরা মানে নট নেসেসারিলি আর্টিস্ট তকমা আঁটা লোকজন, যেকোনো মানুষ স্বাগতম। RATATOUILLE 'র সেই যে ডায়ালগটা -"Anyone can Cook" আমরা বিশ্বাস করি 'Anyone can draw'

আমরা কাজ যট্টুকই পারি আর না পারি আমরা কাজ করব একসাথে, এক দেহ হয়ে। ইন্ডিভিজুয়ালিজম অনেক হইসে, নিজের রুমে বইসা বইসা রাজা উজির মাইরা কাঁথার নিচে ঘুমও কম দেই নাই। এইবার একটু সভ্য হবার সময় আসছে, সবাইরে একসাথে ভাবতে হবে। একসাথে আঁকতে হবে
আঁকান্তিস এর মুল কথাটা তাই প্রথমতঃ ...Let's draw
পরিশেষে যারা কী দিয়া আঁকুম? কেমনে আঁকুম, আমার তো কম্পিউটার নাই- ইত্যাদি নিয়া চিন্তিত তাদের জন্য বসের একটা ডায়ালগ
কোট করা গেল—

"We artists are indestructible;
even in a prison, or in a concentration camp,
I would be almighty in my own world of art,
even if I had to paint my pictures with my wet tongue on the dusty floor of my cell."
 -- Pablo Picasso